প্রশান্ত মৃধা
সাতপাঁচ না ভেবেই লিখে যায়, স্বাধীনতার এই চলি্লশ বছরে বাংলাদেশের সমাজ এগিয়েছে। স্বাভাবিক সচলতার নিয়মেই এই অগ্রগতি। কিন্তু যে কোনো সমাজ গঠনের হিসাব অনুযায়ী, কোনো প্রকার সমাজতাত্তি্বক পর্যালোচনার ধার না ধেরেই এ কথাও তো সত্য, চলি্লশ বছর কোনো সমাজকে নিয়ে ধরাবাঁধা কথা বলার জন্য সময় হিসেবে কমই বটে। আমাদের সমাজের ক্ষেত্রে সেখানে স্পষ্ট পর্বান্তর মুক্তিযুদ্ধ। গত চলিল্গশ বছরের সমাজকে যে একটানে বিবেচনায় আনা হচ্ছে, সে তো এ জন্য যে, মুক্তিযুদ্ধ এই রাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোয় সেই মোটা দাগ_ যার ভেতর দিয়ে এই দেশের সমাজ কাঠামো এর আগের ও পরের
অবস্থায় চিহ্নিত হয়ে আছে। আগের সমাজ পাকিস্তান রাষ্ট্রের, পরেরটা বাংলাদেশের।
এই যে এগিয়ে যাওয়া, যাকে প্রগতি বলি, চিহ্নিত করছি অর্জন হিসেবে, অন্য দিক দিয়ে তা এক আপেকি অভিধামাত্র, নদীর প্রবাহের মতো। নদী তার কান্তিহীন পথচলায় জোয়ারে যেমন ভরে, ভাটিতে খালি হয়; আর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে। কূলভাঙা গৃহত্যাগী মানুষের কান্না সে শোনে কি-না, কেউ জানে না। নতুন যে কূল গড়ে তুলল, সেখানে মানুষের আনন্দ-ফুর্তিতে নদী শরিক হয় কি-না, তাও তো জানা যায় না। কিন্তু নদী বহমান। আবার নদী শুকিয়েও যায়; প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে, পাহাড়ে প্রবাহের উৎস না থাকলে। রাষ্ট্রের প্রাণ তার সমাজ। সমাজের অগ্রগতি নদীর প্রবাহেরই মতো। সে কিছু হারায়, কিছু অর্জন করে।
যদিও গত চলিল্গশ বছরে বাংলাদেশের নদনদীর গোনাগুনতিহীন শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্জনকে তুলনা করতে একটু সংকোচ, একটু বাধো বাধো ঠেকছে। কিন্তু যে কোনো দিক থেকে নিজের সমান বয়সী এই দেশের সমাজ কাঠামোর সামগ্রিক চলমানতা, প্রতিবন্ধকতা আর সম্ভাবনার গান গাইতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি তো এক নদীর কিনারে। 'সোনার তরী' কবিতার সেই কৃষকেরই মতো প্রায়। কোনো আধ্যাত্মিক চেতনের প্রশ্ন এ নয়, সরল সাদাসিধে বস্তুতন্ত্রের মোড়কে যদি চিন্তা করি, এত দিনে ওই সোনার তরীতে তোলা ফসলের মতো এই সমাজের অর্জন কী কী? এই দেশের সমাজ এগিয়েছে না পিছিয়েছে, না শত প্রতিবন্ধকতায় স্থবির হয়ে আছে, নাকি প্রতিবন্ধকতার মুখে ছাই দিয়ে নিজের মতো করে নিজে এগিয়ে একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে?
কোনো জাতির, কোনো দেশের সমাজ সব সময়ই আগায় বা পেছায়_ এক জায়গায় থাকে না। থাকতে পারে না। কেননা, সমাজের প্রধান উপাদান মানুষ। মানবজীবন চলমান, শত প্রতিবন্ধকতার মুখেও সে নিজের পথ হাঁটে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই মানবসমাজ এগিয়ে যেতে পারে ও স্থবির হয়েও পড়তে পারে, হয়ে পড়েও। ইতিহাসে সে নজির আছে। সেখানে জীবন হয়তো স্রোতহীন ছিল না, কিন্তু সমাজের অগ্রগতি বলতে যা বুঝি আমরা_ সেটি ঘটেনি।
সেই দিক থেকে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম, খুব গাঢ় দাগেই ব্যতিক্রম। এই রাষ্ট্রের সমাজ এগিয়েছে। স্বাধীনতার পরে দ্রুতই। নিজের মতো করে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রশক্তির কারণে যা সম্ভব ছিল না, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই সম্ভাবনাগুলো তৈরি করেছে। গত চলিল্গশ বছরে শোষণের বঞ্চনার লাঞ্ছনার, ধর্মের শোষণ ও অন্ধতার শত ত গায়ে নিয়ে দেশ এগিয়েছে। এটা চোখ খুলেই বোঝা যায়। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের প্রশ্নে, নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্কের প্রশ্নে, সমাজের ভেতরে-বাইরে স্পষ্ট বিভিন্ন য় ও পুঁজ, আবার রূপান্তর ও সমৃদ্ধি নিয়েই এগিয়েছে। তা নিয়ে বলার কিছু প্রায় নেই। আলো জ্বললে দেখা যায়। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর অর্জনগুলো আলোর মতো। তা প্রায় দিনের মতো প্রকাশ্যে চেয়ে পড়লেই দেখা যায়। তবে যা একদম খুব সরাসরি চেয়ে পড়লেও সব সময়ে দেখা হয়ে ওঠে না তা হলো, এ দেশের সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের শ্রম, শ্রমিকের অকান্ত পরিশ্রম_ সেই কৃতিত্ব বারবার লুঠ হয়েছে। তবু খাদ্যে সম্পূর্ণতা আর বেঁচে থাকার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রমে অংশগ্রহণ সমাজের সচলতার প্রকাশ। আর শিায়, সে যে মানের শিাই হোক_ নারীর অংশগ্রহণ খুব চোখে পড়ে।
কিন্তু এর মানে তো এই নয়, গত চলিল্গশ বছরে এই পর্যন্ত আসতে পথের কোথাও কাঁটা বিছানো ছিল না, এক ফুল বিছানো পথ পাড়ি দিয়ে সমাজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে? সে কথা গলা খুব উঁচু করে বলা যাবে না।
খুব ছোট আর সংপ্তি অর্থে সমাজ বলতে যা বুঝি আমরা, তা আসলে খুব ছোট এক-একটি জনগোষ্ঠীর সমাবেশ। গাঁও গেরামে ছোট এক জনগোষ্ঠীকেই মাথায় রেখে যেমন বলা হয়, 'আমাদের সমাজ'। এটাকে সমাজ নামে চিহ্নিত করলেও, এর বৃহত্তর রূপটি নিয়ে যে গোটা দেশ, তাও তো জানা আছে আমাদের। সেই হিসাবে ওপর থেকে_ যাকে জাতীয় রাজনীতি বলি, তার খুব ুদ্র দাহ কখনও ঘুণ হয়ে, কখনও অজগরের মতো গিলে ফেলে সমাজের একদম ভেতরে বারবার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। তাকিয়ে দেখলে তা হয়তো মনে হয় সমাজেরই ভাঙন, কিন্তু আসলে সমাজের গায়ে তা লেপে দিয়েছে ওপর থেকে বোঝা হয়ে আসা রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। এটি বরং গত চলিল্গশ বছরে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য দায়ী; আবার কখনও কখনও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত সামাজিক স্থবিরতাকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। তাতে দেশের কন্দরেও সচলতার কিছু বাতাস খেলেছে।
অর্জন আর প্রতিবন্ধকতার যে চিত্র আমাদের সামনে থাকে তার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনায় এখন সচল আমাদের সমাজ। কিন্তু সমাজকে সচল রাখতে বিবিধ অবিমৃশ্য যেসব কলাকৌশল, তা যে আগামী দিনে সমাজের ভেতরের ভাঙনকে উসকে দেবে না, তা বলা যাচ্ছে না। প্রতিদিন আরও আরও মানুষের ভারে উপচে পড়ছে রাজধানীসহ বড় শহরগুলো। তার মানে গ্রাম কী আধা শহর কী ছোট শহরে_ এই সবখানে যে সমাজের গড়ন ছিল এতকাল, তা আগেই ভেঙে গেছে। ভাঙছে প্রতিদিন। মানুষ শহরমুখী। কৃষি ভিন্ন সেখানে আর কোনো কাজে নেই। আবার এনজিওর কায়কারবার আর দাতাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপত্র মোতবেক যে মানুষ নিজের সর্বস্ব দিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চায়, নিজের অজান্তে রাষ্ট্রের উন্নয়নের কাতারে দাঁড়ায়, সে তো 'উন্নয়নের জোয়ারে' ভাসতে ভাসতে একদিন ভূমিশূন্য এক রিক্ত মানুষেই পরিণত হচ্ছে। এরপর নগরে মহানগরে রাজধানীতে গিয়ে শ্রম দিয়ে বেঁচে থাকে। তবু ঠিকঠাক বাঁচে কই? ফলে, এই প্রক্রিয়ার ভেতরে থেকেও যে প্রায় অচল অনড় এক সমাজের কল্পনা করার অভ্যাস ছিল আমাদের, সে সমাজ ভেঙে গেছে অনেক আগেই, নিঃস্ব মানুষের পদভারে কান্ত নগর। সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব চোখে পড়ে না। কিন্তু পড়তে কতণ। নগর যে সুবিধার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, অন্যকে ফাঁকি দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে, সেখানে খুব বেশি দিন আর নিঃস্ব মানুষের ভার বহন করা হয়তো সম্ভব হবে না। আর, বঞ্চনার প্রশ্নে নিঃস্ব মানুষের ভেতরে আগুনও হয়তো বেশি দিন চাপা থাকবে না।
এদিকে তাই জাতি হিসেবে বাঙালিকে যে খুব অলস হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়, সে কথা তখন আর এসব মানুষের শুধু একমুঠো ভাতের জন্য খাটুনি দেখলে বলা যাবে না। সেই দিক থেকে এই শ্রমই আমাদের সমাজের শক্তি। যা দেওয়ার মতা মধ্যবিত্তের নেই। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের পদলেহন আর সুবিধার ঘি মাখনের দিকে চোখ দিয়ে দিয়ে, বাজার অর্থনীতির পণ্যভারে কান্ত হয়ে নিজেকে এতটাই প্রযুক্তি ও পরশ্রমনির্ভর করে তুলেছে যে, তার আর কোনো প্রকার শ্রমে ও ঘামে নিজেকে চালানোর কথা চিন্তা করতেও সাহসে কুলাচ্ছে না। ফলে সমাজের মধ্যবিত্তস্তর আগের তুলনায় স্থবির। উৎসাহশূন্য আর হতাশও। উচ্চবিত্তের মতো এ দেশের বাতাসে তারও চোখজুড়ে আসে কান্তি। তার চোখে কল্পনার যত সুখ বিদেশে। করপোরেট আয়রোজগার তাকে সে ভাবনারও সুযোগ দিয়েছে। ফলে সামাজিক সম্ভাবনায় আমাদের সামনে থাকছে একমাত্র শ্রমজীবী মানুষ, যার শ্রমে আর ঘামে টিকে থাকবে এই সমাজ।
এদিকে যোগাযোগ আর যাতায়াত গ্রামীণ জনপদের একদম চোখের সামনে পর্যন্ত পেঁৗছে গেছে। তার মতায় এখন মানুষে মানুষে আন্তঃসম্পর্ক মনে হয় খুব নিবিড়। কিন্তু ভেতের চোরাস্রোতের টানে ঘটেছে উলটোটা। এত কাছে থাকা, এত কাছে আসা মূলত মানুষকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এটি এতদিনকার যূথবদ্ধ আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। মানুষে মানুষে মানবিক সম্পর্ক আর যোগাযোগের ভেতরে দিয়ে যে এগিয়ে যাওয়া_ সেখানে পরিবর্তন এসেছে। আর, মানুষে মানুষে উপরি যোগাযোগ বেড়েছে। আবার এর ভেতরেও প্রজন্মে প্রজন্মে তফাৎ আর সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিদ্যমান। ফলে, প্রজন্মে প্রজন্মে এই তফাৎ, একপ্রকার পার্থক্য ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। সমাজের সব স্তরেই তা ঘটেছে। একেবার গ্রামীণ থেকে শুরু করে নাগরিক উচ্চবিত্তের সদ্য তরুণ-তরুণীটির সঙ্গে তার আগের প্রজন্মের মানুষের চেতনাগত ফারাক ঘটে গেছে বেশ। এটাকে কোনোভাবেই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। হবেও না আর। যেমন সহসা উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্তের ও ভূমিহীনের কোনো প্রকার সম্পর্ক সংযোগ তৈরি করা সম্ভব নয়। সমাজের সেই কাঠামোয় যে ঘুণ গোটা দেশেই ধরেছে, সেখানে অন্যকে ঠকিয়ে রাতারাতি নিজের ধনী হওয়ার কোন রাস্তায় যে উঠছে_ তার প েআর পেছনে ফিরে তাকানো কী করে সম্ভব? বাংলাদেশকে আরও বহুদিন এর ভার বইতে হবে। তবু নিঃস্ব মানুষ বুক বেঁধে দাঁড়াবে। তার লুট হয়ে যাওয়া হিস্যার খোঁজ না নিয়ে নিজের ঘাম ঝরিয়ে সচল রাখবে সমাজকে।
বোঝা যাচ্ছে, গত চলিল্গশ বছরে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, আর আগামী দিনে যা কিছু সম্ভাবনা তা এই সমাজকাঠামোর একদম নিচের স্তরের মানুষের কাছে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ উচ্চ ও মধ্যবিত্তকে ইতিমধ্যে সেই সম্ভাবনা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষও আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি ও সংস্কৃতির খপ্পর থেকে মুক্ত নয়। তবু সম্ভাবনা তাদের হাতেই। সেই সমাজ আরও গতিশীল হবে। সমস্ত ভাঙন ঠেলে চলমান থাকবে, যেমন আছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস