Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

সরকারি বিধি বিধান
তরুণ চোখে দেখা
 
সম্পাদকের
কথা
রক্ত, অশ্রু ও সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা প্রিয় স্বদেশকে স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে পাই। বাঙালির অমিত বিক্রম, অযুত শহীদের আত্মত্যাগ আর জাতির জনক বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের অসীম সাহসী নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ এবার স্বাধীনতার ৪০ বছরে পা দিল। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় চার দশক খুব বেশি সময় না হলেও একটি দেশের গঠন ও বিকাশে কম সময়ও নয়। আর একটি দশক পর আমরা পেঁৗছে যাব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে।
স্বাধীনতার ৪০ বছরে পেঁৗছে দেশের বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমাদের অর্জন, সংকট ও সম্ভাবনা আমরা খুঁজে দেখতে চেয়েছি; আর চেয়েছি এ অনুসন্ধান হোক তারুণ্যের চোখে। সেই তারুণ্য, যাদের প্রত্যেকের জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে, জন্মেই যারা পেয়েছে স্বাধীনতার আস্বাদ, পরাধীনতার শৃঙ্খল বিষয়ে যারা অনভিজ্ঞ এবং যারা দেখেনি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি শোষণ সম্পর্কে যাদের প্রত্যক্ষ কোনো ধারণা নেই_ সেই রকম একঝাঁক তরুণ এবার সমকাল স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যার লেখক।
দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আমরা নির্বাচন করেছি সেসব প্রতিনিধিত্বশীল তরুণকে যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। সম্ভাবনাময় তারুণ্যের চোখে আমরা বাংলাদেশের ৪০ বছরের একটি আদল সন্ধান করেছি। প্রত্যাশা করি, নির্মোহ ও স্পষ্ট চোখে দেখা এসব রচনা থেকে আমরা আধুনিক, যুক্তিনির্ভর, তথ্যভিত্তিক ও স্বপ্নসঞ্চারী একটি বাংলাদেশের ছবি খুঁজে পাব।
প্রিয় বাংলাদেশ_ যার সমৃদ্ধি আমাদের গৌরবান্বিত করে, যার ব্যর্থতা আমাদের বিদীর্ণ করে, সেই বাংলাদেশকে আরও বর্ণিল, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ করতে আজকের তারুণ্যের অপার সম্ভাবনাই যে সবচেয়ে বড় শক্তি তা আমরা বিশ্বাস করি। পূর্ব প্রজন্মের গৌরব ও কীর্তি পরবর্তী প্রজন্মের স্পর্ধিত হাতে এগিয়ে যায় সামনে_ এটিই সমাজ প্রগতির শিক্ষা। আগামী দিনের বাংলাদেশ সব প্রজন্মের সম্মিলিত অংশগ্রহণে নিজের পায়ে সর্বময় মর্যাদায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে_ এই বিশ্বাস অতিশয়োক্তি নয়।
স্বাধীনতার ৪০ বছরে সবাইকে শুভেচ্ছা।
 
রাজনীতি
রাজনীতির সুদিন দুর্দিন
 
শান্তনু মজুমদার
সমাজ ও রাষ্ট্রকে রাজনীতিবিবর্জিত করার একঘেয়ে একটি চেষ্টা বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়। এই চেষ্টা বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থা আর রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বরূপ বিচার-বিবেচনায় নেয় না। বরং গুটি কয় রাজনৈতিক দলের রাজনীতিকদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডকে সামনে তুলে এনে একগাদা সুপারিশ হাজির করা হলেই মোক্ষম কাজটি সেরে ফেলা হয়েছে বলে মনে করে। রাষ্ট্রদেহে বিরাজমান অব্যবস্থাগুলোর নিদানে এমন অবস্থান গ্রহণের মধ্যে সততা, আকুলতা, নিষ্ঠা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু এ ধরনের অবস্থানের মধ্য দিয়ে রাজনীতির অর্জনকে বাহবা দেওয়া, কোনো প্রতিবন্ধকতা থেকে থাকলে সেগুলোকে গভীর থেকে চিনতে শেখা বা সম্ভাবনাগুলোকে চিহ্নিত করাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অবশ্য রাজনীতি ও রাজনীতিকদের কর্মকাণ্ড দেখে 'গায়ে জ্বালা ধরে যায়' জাতীয় মধ্যবিত্ত ফ্যাশনেবল একটি অবস্থান গ্রহণের মানসিকতা অর্জনে সমর্থ হলে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
২.
অর্জন, প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনাগুলো নিয়ে কথা বলার সময় বে-ইয়াদ হলে চলবে না, বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি 'মুক্তবাজারি' ও পুঁজিবাদকামী। কোটি কোটি ভোট পাওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদী আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে এই একটি ক্ষেত্রে কোনো মতভেদ নেই। আর এহেন একটি ব্যবস্থার মধ্যে জনমঙ্গল সাধন সম্ভব বলে বিশ্বাসীরা স্বভাবতই একটি বুর্জোয়া গণতন্ত্র তথা পশ্চিমা উদারনৈতিক ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। আবারও মনে করা যাক, আমরা মূলধারার রাজনীতির কথা বলছি। পুঁজিবাদ ভালো না খারাপ, উদারনৈতিক গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে সব মানুষের কল্যাণ সাধনে সক্ষম কি-না, যদি সক্ষম না হয় তাহলে কোনো বিকল্প আছে কি-না সেসব ব্যাপারে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে পূর্ণদৈর্ঘ্য তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু একমাথা একভোট ব্যবস্থায় লোকে কাদের ভোট দেয় এবং যাদের ভোট দেওয়া হয় তারা কী করে, দিনের শেষে তাই হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়। কেননা সাংবিধানিক রাজনীতিতে ক্ষমতা হাতে আসে ভোটের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি কিছু দেয়নি বলে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেন। সত্যি কি তাই? ছিয়ানব্বইয়ের ফেব্রুয়ারি আর এক-এগারো অধ্যায় বাদ দিলে নব্বইয়ের পর থেকে নিয়মিত ভোট, ভোটে জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণ খারাপ কী? সরকার-সংশিল্গষ্ট এই অর্জনগুলোর বাইরে একটু ভিন্ন দিক থেকে দেখলে ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় সামরিক জান্তার পতনের চূড়ান্তলগ্নে মূলত প্রধান দুই দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান চালু করা ও পরবর্তীকালে এ ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের স্বরূপ উন্মোচন করে দেওয়াটাই হচ্ছে মূলধারার কাছ থেকে জনগণের বড় প্রাপ্তি। অনির্বাচিত একটি কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার অদৃষ্টপূর্ব এক বিধান চালুর মধ্য দিয়ে মূলধারার রাজনীতির শক্তিমান পক্ষগুলো পরস্পরের প্রতি চূড়ান্ত অবিশ্বাস ও উদারনীতিক গণতন্ত্রে ক্ষমতার হাতবদলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পরিচালনায় নিজেদের অক্ষমতা নিজেরাই প্রণালিবদ্ধভাবে উন্মোচিত করে দেয়। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও নিজেদের অক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়ার একটা সুফল হচ্ছে মূলধারার বর্তমান দলগুলোর ব্যাপারে সাধারণের মোহমুক্তি। ভোটের ফল দিয়ে নয় বরং ভোটের জন্য সাধারণ ভোটারদের দল বাছাইয়ের জায়গা থেকে মোহমুক্তির বিষয়টিকে দেখলে বুঝতে সুবিধা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, কোনো একটি দলের জন্য নিবিড় আনুগত্য বা মানসিক অনুভূতি ধারণকারীদের বাইরের সাধারণ ভোটাররা এখন আর কোনো স্বপ্ন বা প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্য থেকে মূলধারার কোনো দলকে ক্ষমতায় পাঠাচ্ছে না বরং পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীনদের যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচারের সাজা হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী দলটিকে ভোট দিচ্ছে। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, সূক্ষ্ম

কারচুপি, মোটা কারচুপির মতো কথাবার্তাগুলো মাথায় রাখলেও ওপরে উল্লেখ্য প্রবণতাটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। অনাগত দিনগুলোতে বর্তমানের মূলধারা নিজেকে নতুন করে সাজাবে কি-না বা সাজাতে বাধ্য হবে কি-না তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে চলতি মূলধারাকে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করে জনগণ নতুন একটি মূলধারার জন্ম দেবে কি-না তা নির্ভর করছে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ ছাড়াও সমাজদেহের মধ্যে অন্য কোনো মতাদর্শ নিজেদের কতটা অনুপ্রবিষ্ট করতে পারে সে সক্ষমতার ওপর।
রাষ্ট্রকর্ম ও রাজনীতিতে সেনা-ছোপ লাগার ব্যাপারে মূলধারার বড় দুই দলের প্রকাশ্য আপত্তির ব্যাপারটিও বাংলাদেশের রাজনীতিক সংস্কৃতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ অবস্থানটি ইতিবাচক এই কারণেই যে, সেনাছাউনিতে জন্ম নেওয়া দলকেও এখন সেনা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অত্যন্ত দৃঢ় কথাবার্তা বলতে শোনো যাচ্ছে।
৩.
রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে শুরুতে বলে নেওয়া যাক যে বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রত্যাশী বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির জন্য তেমন বড় কোনো প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ এ মুহূর্তে জারি নেই। ভোট হচ্ছে, লোকে ব্যাপকভাবে ভোট দিচ্ছে। এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটলেও তা স্থায়ী হতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মুরবি্বরা দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে। বিরোধীরা সংসদে যেতে চান না নানা অজুহাতে; কিন্তু তাতে কি; তারা নির্বাচনে যাবেন। বর্তমান বিরোধী দল তো ইতিমধ্যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে ফেলেছে। গালাগালি, মারামারি বা রক্তপাতের মতো সমস্যাগুলো পশ্চিমে উদ্ভূত উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের মূলধারার নিম্নমান প্রমাণ করে বটে; কিন্তু এর ফলে চলমান ব্যবস্থাটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে তা ঠিক বলা যাবে না।
অনেকের আক্ষেপ আজকের দিনে ধনী মানুষের দাপটে সত্যিকারের রাজনীতিকরা রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে পারছেন না। কথা ঠিক, কিন্তু এই প্রবণতা বন্ধের কোনো উপায় আছে কি? দলের পেছনে বণিকরা যে এন্তার টাকা খরচ করে তা কে না জানে? এতে প্রাথমিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য নির্বিঘ্ন করা ও সুযোগ-সুবিধাদি বাগিয়ে নেওয়ার মতো ব্যাপারাদি থাকলেও এক পর্যায়ে এসে বণিকের শাসক হওয়ার ইচ্ছা হতেই পারে। শুধু শাসন করতে পারার স্বাদ নেওয়ার জন্য নয়, বরং বাণিজ্য সুরক্ষা ও প্রসারের বিষয়টিও এখানে জড়িত। তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা কি নেই? অবশ্যই আছে; তবে তা মূলধারার জন্য নয়। এই প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মুক্তবাজার, বিশ্বায়নসহ নানা নামে নানা অজুহাতে শোষণ-লুণ্ঠনকারী দেশি-বিদেশি শক্তিগুলোর প্রগতিশীল বিরোধিতা যারা করে তাদের জন্য।

৪.
গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে যা কিছু চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে, চলতি ব্যবস্থাটি যদিও নির্বাচন পদ্ধতির বিচারে সংসদীয় কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এতটুকু গণতান্ত্রিক নয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সাধারণ সংস্কৃতি ও সহবত থেকে বহু দূরে এর অবস্থান যদিও মূলধারার দলগুলোর মধ্যে মানের বিচারে বড় ধরনের হেরফের আছে। তবে গণতন্ত্রের নামে বিরাজমান নিদারুণ নেতিবাচক প্রবণতাগুলোর মধ্যেও গুটিকয় ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে।
ইতিবাচক প্রবণতাগুলোর ক্ষেত্রে প্রথম উল্লেখ করা যেতে পারে জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক মাত্রার সমর্থন ও সম্পৃক্তি। জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী পরিবেশ-প্রতিবেশবিরোধী কয়লা উত্তোলন, বহুজাতিকের হাতে গ্যাস সম্পদ তুলে দেওয়া কিংবা সমুদ্রবন্দর ইজারা দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলো এখন আর সমাজের অগ্রসর অংশের 'চেতনার উদয়ের' জন্য পথ চেয়ে বসে থাকার পর্যায়ে নেই; এই আন্দোলনগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এ আন্দোলনগুলোর ব্যাপারে মূলধারার দলগুলোর সমর্থক বা কর্মীদের অনেকের মুখ থেকেও ইতিবাচক কথাবার্তা শুনতে পাওয়া এখন আর দুর্লভ ঘটনা নয়। জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে একদিকে গণমানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকা, অন্যদিকে মূলধারার লোকদের মধ্যেও জাতীয় স্বার্থের প্রসঙ্গে দলীয় আনুগত্য বা অবস্থানকে একপাশে রেখে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির বাস্তবতাতে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
কোনো দলের দিকে চেয়ে না থেকে, বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতির ওপর নির্ভর না করে ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে দল-মত নির্বিশেষে স্থানীয় পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং এ ধরনের আন্দোলনের পক্ষে দল-মত নির্বিশেষে মোটাদাগের সমর্থনের প্রবণতাটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আরেকটি সম্ভাবনাময় ইঙ্গিত বহন করে। বছর কয়েক আগের কানসাট, শনিরআখড়া কিংবা গত মাসে আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের ঘোষণা বিরোধী আন্দোলন থেকে এই প্রবণতাটি ধারাবাহিক হয়ে উঠছে বলে মনে করা যায়। সর্বশেষ আন্দোলনটি থেকে নতুন করে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, বিরোধী দলের চক্রান্ত, বিশেষ মহলের উস্কানির যুক্তি দেখিয়েও স্থানীয় পর্যায়ে দুরন্ত গতিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের গুরুত্ব অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয়নি। আড়িয়ল বিলের ক্ষেত্রে একথাও জানানো হয়েছিল যে বিলের জমি অবৈধ দখলে রাখা লোকরাই নিজেদের স্বার্থে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। একান্ত দলীয় লোকজন ছাড়া সরকারের এসব কথাবার্তা মানুষজন খুব একটা কানে তোলেনি।

প্রযুক্তির অগ্রগতির সুবাদে ক্রমেই অধিক সংখ্যক মানুষের সামনে বিদ্যমান ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে সুলভে আনসেন্সরড আলাপ-আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ উন্মুক্ত হতে থাকার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা উন্মুক্ত হচ্ছে বলে মনে হয়। সংবাদপত্র, রেডিও বা টেলিভিশনের তুলনায় ই-মেইল বা ফেইসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোর বড় সুবিধা হচ্ছে এগুলোর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হওয়ার সুযোগ প্রযুক্তিগত এবং বৈশ্বিক বাস্তবতার কারণেই অনেক কম। আরেক দিক থেকে দেখলে_ সংবাদপত্র, রেডিও বা টেলিভিশনের সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাণিজ্যের প্রসঙ্গটি জড়িত থাকায় বা অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই মালিকানায় থাকায় এসব জায়গায় সব সময় স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ অবারিত হওয়ার প্রশ্নটিও অবান্তর। পক্ষান্তরে ই-মেইল, ফেইসবুক বা টুইটারের মতো মাধ্যমগুলো ব্যক্তিগত ইচ্ছামাফিক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে সমমনাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর হিসেবে ইতিমধ্যে প্রমাণিত।

ধরে নেওয়া যায় , বিদ্যুতায়নের আওতায় আসা মানুষের সংখ্যা সামনের দিনগুলোতে বাড়তে থাকবে। একই সঙ্গে মুনাফা বাড়ানোর তাগিদ থেকে ইন্টারনেট প্রযুক্তি ও কম্পিটারের দাম অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ক্রমাগত সস্তা হবে এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে; মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে যা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। এ ধরনের বাস্তবতা একবার তৈরি হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীন ভাবনাগুলোকে একক বা যূথবদ্ধভাবে প্রচার বা প্রসারের সুযোগ বর্তমানের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যাওয়া। যথাযথ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেওয়া গেলে নতুন সুযোগগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা বা পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব। অবশ্য প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতার ব্যাপারে সতর্ক না থাকলে এবং প্রযুক্তি হস্তগত থাকার সুবাদে মাঠে না নেমে ঘরে বসেই বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরোধিতা করে ফল পাওয়া সম্ভব মনে করার নির্বুদ্ধিতা পাকাপোক্ত হয়ে গেলে আখেরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের কয়েক নিযুত গার্মেন্ট শ্রমিকের আন্দোলন-সংগ্রামের বাস্তবতাও সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতির ওপরে মোটাদাগের রেখাপাতের একটি সম্ভাবনা তৈরি করছে। চূড়ান্ত শ্রম শোষণের প্রতিবাদ আর জীবন ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে গার্মেন্ট শ্রমিকরা কখনও অসংগঠিত কখনওবা স্বল্পস্থায়ী কিন্তু কিছুটা হলেও সংগঠিত প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক দিন ধরেই। লক্ষণীয় বিষয়_ পুলিশি নিপীড়ন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা আর মালিক-বান্ধব মিডিয়াতে ন্যায্য মজুরি, ন্যায্য সম্মান আদায়ের এ লড়াইকে বিদেশি চক্রান্ত, সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র, জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতাসহ নানা তকমা দেওয়া হলেও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রমিকদের এ প্রতিরোধ পর্বটির সমাপ্তি টানা যাচ্ছে না।
জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, স্থানিক পর্যায়ে গড়ে ওঠা ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন, গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন-সংগ্রাম আর তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমেই সুলভ হয়ে ওঠার মতো বাস্তবতাগুলো সামনের দিনে বাংলাদেশের বুর্জোয়া রাজনীতিকে নানা ফর্মে প্রভাবিত করার একটি সম্ভাবনা তৈরি করে ফেলেছে। তবে প্রভাবের স্বরূপ শেষ পর্যন্ত কেমন হবে তা বহুলাংশে নির্ভর করবে আন্দোলন-সংগ্রামগুলোতে নেতৃত্বদানকারী মানুষের সামাজিক অবস্থান, গণমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারার সামর্থ্যের মাত্রা ও রাজনৈতিক চেতনার মানের ওপর।
শান্তনু মজুমদার : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
 
সমাজ
শ্রমে আর ঘামে

প্রশান্ত মৃধা
সাতপাঁচ না ভেবেই লিখে যায়, স্বাধীনতার এই চলি্লশ বছরে বাংলাদেশের সমাজ এগিয়েছে। স্বাভাবিক সচলতার নিয়মেই এই অগ্রগতি। কিন্তু যে কোনো সমাজ গঠনের হিসাব অনুযায়ী, কোনো প্রকার সমাজতাত্তি্বক পর্যালোচনার ধার না ধেরেই এ কথাও তো সত্য, চলি্লশ বছর কোনো সমাজকে নিয়ে ধরাবাঁধা কথা বলার জন্য সময় হিসেবে কমই বটে। আমাদের সমাজের ক্ষেত্রে সেখানে স্পষ্ট পর্বান্তর মুক্তিযুদ্ধ। গত চলিল্গশ বছরের সমাজকে যে একটানে বিবেচনায় আনা হচ্ছে, সে তো এ জন্য যে, মুক্তিযুদ্ধ এই রাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোয় সেই মোটা দাগ_ যার ভেতর দিয়ে এই দেশের সমাজ কাঠামো এর আগের ও পরের

অবস্থায় চিহ্নিত হয়ে আছে। আগের সমাজ পাকিস্তান রাষ্ট্রের, পরেরটা বাংলাদেশের।
এই যে এগিয়ে যাওয়া, যাকে প্রগতি বলি, চিহ্নিত করছি অর্জন হিসেবে, অন্য দিক দিয়ে তা এক আপেকি অভিধামাত্র, নদীর প্রবাহের মতো। নদী তার কান্তিহীন পথচলায় জোয়ারে যেমন ভরে, ভাটিতে খালি হয়; আর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে। কূলভাঙা গৃহত্যাগী মানুষের কান্না সে শোনে কি-না, কেউ জানে না। নতুন যে কূল গড়ে তুলল, সেখানে মানুষের আনন্দ-ফুর্তিতে নদী শরিক হয় কি-না, তাও তো জানা যায় না। কিন্তু নদী বহমান। আবার নদী শুকিয়েও যায়; প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে, পাহাড়ে প্রবাহের উৎস না থাকলে। রাষ্ট্রের প্রাণ তার সমাজ। সমাজের অগ্রগতি নদীর প্রবাহেরই মতো। সে কিছু হারায়, কিছু অর্জন করে।
যদিও গত চলিল্গশ বছরে বাংলাদেশের নদনদীর গোনাগুনতিহীন শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্জনকে তুলনা করতে একটু সংকোচ, একটু বাধো বাধো ঠেকছে। কিন্তু যে কোনো দিক থেকে নিজের সমান বয়সী এই দেশের সমাজ কাঠামোর সামগ্রিক চলমানতা, প্রতিবন্ধকতা আর সম্ভাবনার গান গাইতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি তো এক নদীর কিনারে। 'সোনার তরী' কবিতার সেই কৃষকেরই মতো প্রায়। কোনো আধ্যাত্মিক চেতনের প্রশ্ন এ নয়, সরল সাদাসিধে বস্তুতন্ত্রের মোড়কে যদি চিন্তা করি, এত দিনে ওই সোনার তরীতে তোলা ফসলের মতো এই সমাজের অর্জন কী কী? এই দেশের সমাজ এগিয়েছে না পিছিয়েছে, না শত প্রতিবন্ধকতায় স্থবির হয়ে আছে, নাকি প্রতিবন্ধকতার মুখে ছাই দিয়ে নিজের মতো করে নিজে এগিয়ে একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে?
কোনো জাতির, কোনো দেশের সমাজ সব সময়ই আগায় বা পেছায়_ এক জায়গায় থাকে না। থাকতে পারে না। কেননা, সমাজের প্রধান উপাদান মানুষ। মানবজীবন চলমান, শত প্রতিবন্ধকতার মুখেও সে নিজের পথ হাঁটে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই মানবসমাজ এগিয়ে যেতে পারে ও স্থবির হয়েও পড়তে পারে, হয়ে পড়েও। ইতিহাসে সে নজির আছে। সেখানে জীবন হয়তো স্রোতহীন ছিল না, কিন্তু সমাজের অগ্রগতি বলতে যা বুঝি আমরা_ সেটি ঘটেনি।
সেই দিক থেকে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম, খুব গাঢ় দাগেই ব্যতিক্রম। এই রাষ্ট্রের সমাজ এগিয়েছে। স্বাধীনতার পরে দ্রুতই। নিজের মতো করে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রশক্তির কারণে যা সম্ভব ছিল না, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই সম্ভাবনাগুলো তৈরি করেছে। গত চলিল্গশ বছরে শোষণের বঞ্চনার লাঞ্ছনার, ধর্মের শোষণ ও অন্ধতার শত ত গায়ে নিয়ে দেশ এগিয়েছে। এটা চোখ খুলেই বোঝা যায়। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের প্রশ্নে, নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্কের প্রশ্নে, সমাজের ভেতরে-বাইরে স্পষ্ট বিভিন্ন য় ও পুঁজ, আবার রূপান্তর ও সমৃদ্ধি নিয়েই এগিয়েছে। তা নিয়ে বলার কিছু প্রায় নেই। আলো জ্বললে দেখা যায়। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর অর্জনগুলো আলোর মতো। তা প্রায় দিনের মতো প্রকাশ্যে চেয়ে পড়লেই দেখা যায়। তবে যা একদম খুব সরাসরি চেয়ে পড়লেও সব সময়ে দেখা হয়ে ওঠে না তা হলো, এ দেশের সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের শ্রম, শ্রমিকের অকান্ত পরিশ্রম_ সেই কৃতিত্ব বারবার লুঠ হয়েছে। তবু খাদ্যে সম্পূর্ণতা আর বেঁচে থাকার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রমে অংশগ্রহণ সমাজের সচলতার প্রকাশ। আর শিায়, সে যে মানের শিাই হোক_ নারীর অংশগ্রহণ খুব চোখে পড়ে।
কিন্তু এর মানে তো এই নয়, গত চলিল্গশ বছরে এই পর্যন্ত আসতে পথের কোথাও কাঁটা বিছানো ছিল না, এক ফুল বিছানো পথ পাড়ি দিয়ে সমাজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে? সে কথা গলা খুব উঁচু করে বলা যাবে না।
খুব ছোট আর সংপ্তি অর্থে সমাজ বলতে যা বুঝি আমরা, তা আসলে খুব ছোট এক-একটি জনগোষ্ঠীর সমাবেশ। গাঁও গেরামে ছোট এক জনগোষ্ঠীকেই মাথায় রেখে যেমন বলা হয়, 'আমাদের সমাজ'। এটাকে সমাজ নামে চিহ্নিত করলেও, এর বৃহত্তর রূপটি নিয়ে যে গোটা দেশ, তাও তো জানা আছে আমাদের। সেই হিসাবে ওপর থেকে_ যাকে জাতীয় রাজনীতি বলি, তার খুব ুদ্র দাহ কখনও ঘুণ হয়ে, কখনও অজগরের মতো গিলে ফেলে সমাজের একদম ভেতরে বারবার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। তাকিয়ে দেখলে তা হয়তো মনে হয় সমাজেরই ভাঙন, কিন্তু আসলে সমাজের গায়ে তা লেপে দিয়েছে ওপর থেকে বোঝা হয়ে আসা রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। এটি বরং গত চলিল্গশ বছরে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য দায়ী; আবার কখনও কখনও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত সামাজিক স্থবিরতাকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। তাতে দেশের কন্দরেও সচলতার কিছু বাতাস খেলেছে।
অর্জন আর প্রতিবন্ধকতার যে চিত্র আমাদের সামনে থাকে তার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনায় এখন সচল আমাদের সমাজ। কিন্তু সমাজকে সচল রাখতে বিবিধ অবিমৃশ্য যেসব কলাকৌশল, তা যে আগামী দিনে সমাজের ভেতরের ভাঙনকে উসকে দেবে না, তা বলা যাচ্ছে না। প্রতিদিন আরও আরও মানুষের ভারে উপচে পড়ছে রাজধানীসহ বড় শহরগুলো। তার মানে গ্রাম কী আধা শহর কী ছোট শহরে_ এই সবখানে যে সমাজের গড়ন ছিল এতকাল, তা আগেই ভেঙে গেছে। ভাঙছে প্রতিদিন। মানুষ শহরমুখী। কৃষি ভিন্ন সেখানে আর কোনো কাজে নেই। আবার এনজিওর কায়কারবার আর দাতাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপত্র মোতবেক যে মানুষ নিজের সর্বস্ব দিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চায়, নিজের অজান্তে রাষ্ট্রের উন্নয়নের কাতারে দাঁড়ায়, সে তো 'উন্নয়নের জোয়ারে' ভাসতে ভাসতে একদিন ভূমিশূন্য এক রিক্ত মানুষেই পরিণত হচ্ছে। এরপর নগরে মহানগরে রাজধানীতে গিয়ে শ্রম দিয়ে বেঁচে থাকে। তবু ঠিকঠাক বাঁচে কই? ফলে, এই প্রক্রিয়ার ভেতরে থেকেও যে প্রায় অচল অনড় এক সমাজের কল্পনা করার অভ্যাস ছিল আমাদের, সে সমাজ ভেঙে গেছে অনেক আগেই, নিঃস্ব মানুষের পদভারে কান্ত নগর। সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব চোখে পড়ে না। কিন্তু পড়তে কতণ। নগর যে সুবিধার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, অন্যকে ফাঁকি দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে, সেখানে খুব বেশি দিন আর নিঃস্ব মানুষের ভার বহন করা হয়তো সম্ভব হবে না। আর, বঞ্চনার প্রশ্নে নিঃস্ব মানুষের ভেতরে আগুনও হয়তো বেশি দিন চাপা থাকবে না।
এদিকে তাই জাতি হিসেবে বাঙালিকে যে খুব অলস হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়, সে কথা তখন আর এসব মানুষের শুধু একমুঠো ভাতের জন্য খাটুনি দেখলে বলা যাবে না। সেই দিক থেকে এই শ্রমই আমাদের সমাজের শক্তি। যা দেওয়ার মতা মধ্যবিত্তের নেই। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের পদলেহন আর সুবিধার ঘি মাখনের দিকে চোখ দিয়ে দিয়ে, বাজার অর্থনীতির পণ্যভারে কান্ত হয়ে নিজেকে এতটাই প্রযুক্তি ও পরশ্রমনির্ভর করে তুলেছে যে, তার আর কোনো প্রকার শ্রমে ও ঘামে নিজেকে চালানোর কথা চিন্তা করতেও সাহসে কুলাচ্ছে না। ফলে সমাজের মধ্যবিত্তস্তর আগের তুলনায় স্থবির। উৎসাহশূন্য আর হতাশও। উচ্চবিত্তের মতো এ দেশের বাতাসে তারও চোখজুড়ে আসে কান্তি। তার চোখে কল্পনার যত সুখ বিদেশে। করপোরেট আয়রোজগার তাকে সে ভাবনারও সুযোগ দিয়েছে। ফলে সামাজিক সম্ভাবনায় আমাদের সামনে থাকছে একমাত্র শ্রমজীবী মানুষ, যার শ্রমে আর ঘামে টিকে থাকবে এই সমাজ।
এদিকে যোগাযোগ আর যাতায়াত গ্রামীণ জনপদের একদম চোখের সামনে পর্যন্ত পেঁৗছে গেছে। তার মতায় এখন মানুষে মানুষে আন্তঃসম্পর্ক মনে হয় খুব নিবিড়। কিন্তু ভেতের চোরাস্রোতের টানে ঘটেছে উলটোটা। এত কাছে থাকা, এত কাছে আসা মূলত মানুষকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এটি এতদিনকার যূথবদ্ধ আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। মানুষে মানুষে মানবিক সম্পর্ক আর যোগাযোগের ভেতরে দিয়ে যে এগিয়ে যাওয়া_ সেখানে পরিবর্তন এসেছে। আর, মানুষে মানুষে উপরি যোগাযোগ বেড়েছে। আবার এর ভেতরেও প্রজন্মে প্রজন্মে তফাৎ আর সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিদ্যমান। ফলে, প্রজন্মে প্রজন্মে এই তফাৎ, একপ্রকার পার্থক্য ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। সমাজের সব স্তরেই তা ঘটেছে। একেবার গ্রামীণ থেকে শুরু করে নাগরিক উচ্চবিত্তের সদ্য তরুণ-তরুণীটির সঙ্গে তার আগের প্রজন্মের মানুষের চেতনাগত ফারাক ঘটে গেছে বেশ। এটাকে কোনোভাবেই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। হবেও না আর। যেমন সহসা উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্তের ও ভূমিহীনের কোনো প্রকার সম্পর্ক সংযোগ তৈরি করা সম্ভব নয়। সমাজের সেই কাঠামোয় যে ঘুণ গোটা দেশেই ধরেছে, সেখানে অন্যকে ঠকিয়ে রাতারাতি নিজের ধনী হওয়ার কোন রাস্তায় যে উঠছে_ তার প েআর পেছনে ফিরে তাকানো কী করে সম্ভব? বাংলাদেশকে আরও বহুদিন এর ভার বইতে হবে। তবু নিঃস্ব মানুষ বুক বেঁধে দাঁড়াবে। তার লুট হয়ে যাওয়া হিস্যার খোঁজ না নিয়ে নিজের ঘাম ঝরিয়ে সচল রাখবে সমাজকে।
বোঝা যাচ্ছে, গত চলিল্গশ বছরে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, আর আগামী দিনে যা কিছু সম্ভাবনা তা এই সমাজকাঠামোর একদম নিচের স্তরের মানুষের কাছে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ উচ্চ ও মধ্যবিত্তকে ইতিমধ্যে সেই সম্ভাবনা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষও আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি ও সংস্কৃতির খপ্পর থেকে মুক্ত নয়। তবু সম্ভাবনা তাদের হাতেই। সেই সমাজ আরও গতিশীল হবে। সমস্ত ভাঙন ঠেলে চলমান থাকবে, যেমন আছে।